সুলেখা আক্তার শান্তা:
জ্যোতি নামটা নাকি দাদি রেখেছিলেন। তিনি জান্নাতবাসী হয়েছেন অনেক আগে। মাতামহ সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে বিরল কোন বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন হয়তো। জীবনটাকে জ্যোতি আলোক উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় করতে পারেনি তবে চেষ্টা করছে। জ্যোতি পড়াশোনায় ভালো। একনিষ্ঠ চেষ্টায় সে এমবিএ কমপ্লিট করে ভালো গ্রেড নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতি চাকুরীর খোঁজ করতে থাকে। স্বনামধন্য এক প্রতিষ্ঠানে প্রথম ইন্টারভিউ। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় সেখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোন কোটা নাই। নিয়োগ হবে সাধারণ মেধা মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। জ্যোতি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস এবং মেধায় সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে। নিয়োগ তালিকায় প্রথম হয় সে। কর্তৃপক্ষ তার নিয়োগ নিশ্চিত করে। মহা আনন্দে মায়ের কাছে সুসংবাদটি জানায়। উল্লসিত মা আনন্দ অশ্রুতে জ্যোতিকে বুকে টেনে নেয়। আনন্দের মাঝে মায়ের মনের শঙ্কা কাটে না। বিধাতা জ্যোতিকে সবদিক দিয়ে পূর্ণ করেছেন একটি দিক ছাড়া। সে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারে না। কণ্ঠনালীর একটি ত্রুটির কারণে কথা বলতে গেলে তার নাকে বাজে। নিটল সুন্দর মুখে অশোভন নাকি কন্ঠে কথা বলা তার জন্য এক বিড়ম্বনা। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে খুব একটা আশার আলো দেখতে পায়নি। কণ্ঠ নালীর জটিল অপারেশনে শতভাগ সাফল্য নিশ্চিত নয়। চাকরি পাবার পর তারা আত্মবিশ্বাস কিছুটা বাড়ে। চলার পথে কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না সব কাজ সে সহজ ভাবে করতে পারে। জ্যোতি চাকরি পাবার পর বিয়ের কিছু প্রস্তাব আসে। জ্যোতির মা আলেয়া মেয়ের জামাই হিসেবে চায় দায়িত্ববান ছেলে।
জ্যোতির খালা মুনিয়ার ছেলে। আসিফকে নিয়ে চিন্তিত পরিবার। পড়ালেখায় অমনোযোগী, ঠেলে ঠুলে এগিয়ে চলেছে। বেয়ারা সঙ্গী সাথীরা তার পরম বন্ধু। ছেলেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা মায়ের। মা ঠিক করে ছেলের বিয়ে দেবে। বিয়ের পর যদি মতিগতির পরিবর্তন হয়। মেয়ের খোঁজ চলতে থাকে। হঠাৎ মনে হয় হাতের কাছে মেয়ে থাকতে এত চিন্তা কেন! ভাবে বোনের মেয়ে জ্যোতির কথা। আপনার মধ্যে সম্পর্ক হলে ভালোই হবে। জ্যোতিকে ঘরের বউ করে আনলে ছেলে ঠিক হয়ে যাবে। জ্যোতি তো মাশাল্লাহ অনেক সুন্দরী। তাছাড়া এখন ভালো চাকরি করে। ছেলে আমার ভালো থাকবে তাতে। জ্যোতিকে ঘরের বউ করে আনতে পারলে আমারও চিন্তা কমে আসবে। মুনিয়া বোনের বাড়ি গিয়ে কাছে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আলেয়া শোন আমি তোর বড় বোন। মায়ের পেটের বোন আমি তোর খারাপ চাইবো না। অনেক ভেবে চিন্তে কথাটা বলছি। তোর মেয়েকে আমি ঘরের বউ করে নিতে চাই। তাতে আমার ছেলেটা মানুষ হইবো তোর মেয়েও ভালো থাকবো। আলেয়া কোন কথা বলে না। এ বিয়ের প্রস্তাবে তার মত নাই। বলে, বুবু আমার কোন বুঝ আসে না। কথা বলার ওইটুকু ত্রুটি ছাড়া আর কোন খুত নাই। আমার এত সুন্দর মাইয়াটা। না বুবু আমি এই বিয়াতে রাজি না। তুই আমার মুখের উপর না বলতেছিস! বোন হইয়া বোনের প্রস্তাব ফেলে দিতে চাস? বুবু তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। তুমি একবার ভেবে দেখো জ্যোতির কথা। মেয়েটা আমার সভ্য শান্ত এত প্যাচগোচ বোঝেনা। বুবু তোমার ছেলে কোন কাজ কাম করে না। এখন করে না ভবিষ্যতে করবে। কাজকর্ম ছাড়া কি কোন মানুষ থাকতে পারে। যা আছে তাতে কাজকর্ম না করলেও চলে যাবে। আমি তোকে বললাম দেখিস জোতিকে ঘরের বউ করতে পারলে ছেলে আমার কাজকর্ম ঠিকই করব। এটা ঠিক ছেলের গায়ের রংটা একটু চাপা। পুরুষ মানুষের জন্য গায়ের রং কোন সমস্যা নয়। ওই যে একটা প্রবাদ আছে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। আর আমি যেখানে আছি তুই এত চিন্তা করিস কেন? জ্যোতির মা মেয়ের দুর্বল দিকটা নিয়ে ভাবে। কোথায় কাদের ঘরে যাবে। খোঁটা দিয়ে বিব্রত করবে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে থাকলে ভালো থাকবে। উপরন্ত আগ্রহ করে নিতে এসেছে। মুনিয়াও ছিল নাছোড়বান্দা, বোনকে রাজি করিয়েই ছাড়ে। আলেয়া মেয়েকে জানায় বিয়ের কথা। জ্যোতি মাকে বলে, মা তুমি কিভাবে এই বিয়েতে রাজি হলে? আমি কিভাবে এই ছেলেকে নিয়ে জীবন পাড়ি দিব। পাগলকে পোষ মানানো যায়। যে পাগল না হয়েও পাগলামি করে তাকে কি পোষ মানানো যায়? আলিয়া বলে, আমি না বলছিলাম, তোর খালা আমাকে এমন অনুনয় করে ধরল আর না বলতে পারলাম না। নিজের জীবন দিয়ে পিতা মাতার কথা মূল্য দেওয়ার রেওয়াজে প্রভাবিত জ্যোতি। ঠিক আছে মা তুমি যেখানে বোনকে না বলতে পারো নাই আমি কিভাবে বলি।
আসিফ জ্যোতির বিয়ে হয়। বেশ বড় অনুষ্ঠান করে। বিয়ের পর খালা জ্যোতিকে বেশ আগলে রাখে। জ্যোতি ঘরে বাইরে সমান দায়িত্বশীল। অফিসে যাওয়ার আগে টুকিটাকি কাজ নিজেই সাড়ে কারো জন্য ফেলে রাখে না। অফিস থেকে ফিরেও তাই করে। আসিফ কাজকর্মের জন্য প্রথমে কিছুদিন সক্রিয়তা দেখিয়ে চুপ মেরে যায়। জ্যোতি আসিফের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করে। আসিফ ভাবে বউ আমার ভালো বেতনে চাকরি করে। আমার গাধার খাটুনি খাটার প্রয়োজন নাই। ভালোই চলছে সব জিন্দেগি এভাবেই চলবে। বউয়ের উপার্জনে নির্ভরশীলদের মতো আচরণ তার। অথর্বদের মতো তার চিন্তা। জ্যোতি লক্ষ্য করে তার খালা অর্থাৎ শাশুড়ির মাঝে অনেক পরিবর্তন। যেকোনো ব্যাপারেই ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। তাতে ছেলের ব্যাপারে ভালো হোক আর মন্দ হোক ছেলে যে ব্যাপারে সায় দেয় তার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। জ্যোতি বিয়ের পরও মুনিয়াকে খালা সম্বোধন করে কথা বলে। একদিন বলেই ফেলে, খালা আপনি তো ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন সেই সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। শাশুড়ি বলে, আমি ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি? আমি ভালো মন্দ কি বুঝিনা। তোমার চেয়ে কি আমার বয়স কম? আমি সন্তানের মা। আমি ভালো বুঝি সন্তানের জন্য কী করতে হবে। বেশ ভালো ক্ষোভ জমে ছিল নিরবে, হঠাৎ তার বিস্ফোরণ ঘটে। হ্যাঁ সন্তানের ভালো বোঝেন দেখে তো আমাকে তার গলায় ঝুলাইছেন। না হলে এই কী হয় আমার কপালে! কলহ চরমে উঠলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি বলে, শোন আমি তোকে বাঁচাইছি। তোকে কে বিয়ে করত? তুই তো প্রতিবন্ধী। জ্যোতির শক্ত প্রতিবাদ। খালা একথা আর একবারও মুখে আনবেন না। আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি ভাল বুঝেন তাঁর বান্দাকে কিভাবে সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ আমাকে এভাবে সৃষ্টি করে যদি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন আল্লাহর বান্দা হয়ে আমিও সন্তুষ্ট। মুনিয়া পান খায় আর জ্যোতিকে এটা ঐটা খোঁচা মেরে কথা বলে। জ্যোতি আমি তোকে একটা কথা বলি। জ্যোতি শুনতে চায় তার কথা। জি খালা বলেন? তোর মাসের বেতন সেটা তো সংসার খরচ লেগে যায়। আমার ঘরটা ঠিকঠাক করতে চাই তোর মায়ের কাছে থেকে কিছু টাকা চেয়ে আন। আসিফ মায়ের কথায় তাল মিলিয়ে বলে, মা তুমি দারুন কথা বলছো, আমার মাথায় এটা আগে আসে নাই। হ্যাঁ জ্যোতি তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে আনো ঘরটা ঠিক করতে পারলে আমরাই তো শান্তিতে থাকতে পারব। আমাদের কিছু টাকা দিলে তোমার মায়ের টাকায় কম পড়বে না।
জ্যোতি ভাবে হায়রে টাকার বিষ। এটা আত্মীয় অনাত্মীয় বোঝেনা। স্বামী এবং শাশুড়ি আরো কয়েকবার কথাটি পুনরায় বলে। জ্যোতি কঠিন স্বরে বলে, আপনারা মা ছেলে যত কথাই বলেন না কেন আমি আমার মায়ের কাছে টাকা চাইতে পারবো না। জ্যোতি মায়ের কাছ থেকে টাকা না আনায় স্বামী আর শাশুড়ির কাছে অনেক কথা শুনতে হয়। তারপরও সে মায়ের কাছ থেকে টাকা আনে না। ছেলে তার বেকার আমি চাকরি করে খাওয়াই তারপরও মায়ের কাছ থেকে টাকা আনবো তা আমার দ্বারা সম্ভব না। জ্যোতির একটা মেয়ে সন্তান হয়। মেয়ে সন্তান নিয়ে তাকে নানা কথা শুনতে হয়। সন্তান হইছে তাও একটা মেয়ে সন্তান। আশা করছিলাম ছেলের তাতো আর হইল না।
টাকা আর ধোঁয়া নাকি লুকানো যায় না। হঠাৎ আসিফ মনে হয় যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেছে। তার হাতে অনেক টাকা আসে। কিভাবে এত টাকা এসেছে জ্যোতি জানতে চায়। আসিফের কথা, কাজকর্ম করো খাও দাও ঘুমাও। এর বেশি কিছু তোমার জানার প্রয়োজন নাই। তুমি কিভাবে টাকা উপার্জন করো সেটা আমি জানব না? না জানা দরকার নেই। তুমি যদি আমাকে না জানাইতে চাও ভালো কথা। তাহলে আমি চাইনা তোমার টাকা সংসারে ব্যবহার হোক। আমি যে বেতন পাই তাতে আমাদের মা মেয়ের চলবে। যত দিন যায় আসিফ আর জ্যোতির মাঝে সম্পর্কের দেয়াল উঁচু হতে থাকে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। জ্যোতি সব জ্বালা যন্ত্রণায় সয়ে নেয় মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে। জ্যোতির মেয়ে বুঝতে শিখেছে। জ্যোতি যখন নীরবে কাঁদে তখন মিলি মায়ের চোখের অশ্রু মুছে দেয়। মা তুমি কেঁদোনা। জ্যোতি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।
একদিন জ্যোতির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ঘুম থেকে উঠেই আসিফ বলে, তোকে তো আমি ডিভোর্স দিয়েছি তিন মাস আগে। তোর আর আমার সংসারে থাকার তোর কোন অধিকার নাই। ডিভোর্স লেটার জ্যোতির হাতে দিয়ে বলে, এটা নিয়ে চলে যা। তোর মতো প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে সংসার করা যায় নাকি? হতবাক জ্যোতি চিৎকার দিয়ে বলে একি সর্বনাশ করলি! ছোট মেয়ে মিলি এখন অনেক কিছু বোঝে। বুঝতে পারে মা বাবার আসন্ন বিচ্ছেদের পরিণতি। বাবার পা ধরে বলে, বাবা আমার মাকে যেতে দিও না। আমার মুখের দিকে তাকাইয়া আমার মাকে রাখো। দাদির কাছে গিয়ে বলে, দাদি আমার মাকে তোমার কাছে রাখো। মুনিয়া কোন কথা বলে না। নাতনির কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মা বাবার বিবাহ বিচ্ছেদের বলি হতে হয় সন্তানদের। মা বাবা জীবিত থাকলেও সন্তানেরা হয়ে যায় এতিম। মিলির মনে ভাসতে থাকে অনেক কথা। কার কাছে থাকবো। যদি তোমার কাছে থাকি বাবা মাকে পাবনা। আর যদি মায়ের কাছে থাকি বাবা তোমাকে পাবো না। বাবা মা তোমরা আমাকে এতিম করোনা। কে শুনে কার কথা। দুই অচেনা প্রান্তকে ভালোবাসা আপন করে নেয়। সন্তানের সুতো সেটা একসঙ্গে গেঁথে ফেলে। এক অচেনা বিতৃষ্ণায় সেই গাঁথুনি ভেঙে পড়ে আর জোড়া লাগানো সম্ভব হয় না। জ্যোতি মেয়েকে বলে, ভয় নাই মা তোর বাবা তোকে ফেলাইলেও আমি ফেলাবো না। আমার রক্ত মাংস দিয়া দশ মাস দশ দিনে তৈরি হয়েছিস তুই। আমার সঙ্গে চল, আমার সঙ্গে থাকবি। মিলির আত্মচিৎকারে কর্ণপাত করে না কেউ। অসহায় জ্যোতি চলে যায় মেয়েকে নিয়ে মায়ের কাছে। ভাগ্য তার প্রসন্ন নিজের পায়ে দাঁড়াবার একটি ব্যবস্থা ছিল তার।
Facebook Comments Box